দারুচিনি গাছের বৈশিষ্ট্যঃ দারুচিনি একটি মাঝারি আকারের ঝোপালো চিরসবুজ বৃক্ষ। দারুচিনি গাছের সাথে তেজপাতা গাছের মিল থাকায় অনেক সময় প্রথম দেখায় চেনা যায় না। তবে তেজপাতার পাতা লম্বাটে ও চিকন, দারুচিনির পাতা তেজপাতার মতো সরু ও লম্বা হয় না। দারুচিনি গাছের বাকল পুরু, মসৃণ, ধূসর রঙের। কচিপাতা চকচকে ও আকর্ষনীয় গোলাপী বর্ণের যা পরে সবুজ হয়। ফুল সাদা, ফল ডিম্বাকার ছড়ায় ঝুলতে থাকে।
দারুচিনির ব্যবহারঃ দারুচিনি প্রধানত গরম মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১০৯ প্রকার মসলা ফসলের চাষাবাদ হয়। বাংলাদেশে প্রায় ২৭ প্রকার মসলা ব্যবহার করা হয় এবং ১৭ প্রকার মসলা জাতীয় ফসল জন্মে থাকে। দারুচিনি এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নিয়েছে। বিভিন্ন খাদ্যশিল্পে সুগন্ধিকারক হিসেবে ব্যবহার হয় এই দারুচিনি। যেমন- বিস্কুট, চকলেট, কেক, পাই ও ডোনাট ইত্যাদি। এছাড়া চায়ের সাথে পানীয় হিসেবে ব্যবহার হয়। ফিরনি, পায়েস, মাংস, পোলাও জর্দা, পিঠা, কোরমা, কোপ্তা, আচার, চাটনি ইত্যাদি রান্নায় দারুচিনি ব্যবহার হয়। দারুচিনির বাকল ও পাতা থেকে এক ধরণের তেল উৎপন্ন হয় যা ঔষধ, প্রসাধন ও খাদ্যশিল্পে ব্যবহার হয়। উন্নত দেশগুলোতে বিশেষ করে আমেরিকায় বিভিন্ন প্রকার রুটিকে সুস্বাদু করতে চিনির সাথে দারুচিনির ব্যবহার করা হয়। বিভিন্ন মিষ্টান্ন ও স্যুপের ভেতর দারুচিনির গুঁড়ো মেশানো হয়। মুখের দুর্গন্ধ দূর করার জন্য দারুচিনি চিবিয়ে খাওয়া হয়। অনেক বিখ্যাত ব্যান্ডের টুথপ্যাষ্টের ভেতর দারুচিনির নির্যাস মেশানো হয়। কোন কোন দেশে দারুচিনি ছত্রাকনাশক হিসেবে, পোকা বিতাড়ক এবং মশা তাড়ানোর জন্য ব্যবহার হয়।
দারুচিনির জমি তৈরি ও চারা রোপণ ঃ জমি ভাল ভাবে চাষ ও মই দিয়ে ঢেলা ভেঙ্গে জমি তৈরি করতে হবে। মাটি চাষ করে উঁচু বীজতলা প্রস্তুত করতে হবে। চারা তৈরির জন্য সাধারণতঃ গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করতে হবে। গাছ থেকে বীজ সংগ্রহের পর দ্রুত তা বীজতলায় বুনতে হবে। বিলম্ব করলে বীজের অংকুরোদগম ক্ষমতা হ্রাস পায়। বীজ ছাড়াও কাটিং বা শাখাকলম বা লেয়ারিং বা দাবা কলম দিয়েও করা যায়। বীজতলায় চারার বয়স ৬ মাস হলেই সেখান থেকে চারা তুলে পলিব্যাগ বা টবে স্থানান্তর করা হয়। বীজতলা থেকে পলিব্যাগে স্থানান্তরিত চারার বয়স ১-২ বছর হলে সাধারণত চারার পাতার রঙ সবুজ হয়ে যায়। কচিপাতার রং থাকে লালচে। চারা রোপণের জন্য সবদিকে ৬০ সে.মি. মাপের গর্ত খুড়ে তাতে চারা লাগাতে হবে। ফিতা বা দড়ি ধরে সারি করে চারা লাগাতে হবে। সারি হতে সারি ও চারার দূরত্ব ২ মিটার রাখতে হবে।
দারুচিনির সার ব্যবস্থাপনা ও আন্তঃপরিচর্যাঃ ভাল ও বেশি ফলনের জন্য দারুচিনি গাছে সার দিতে হবে। প্রতি গর্তে ১০ কেজি জৈব সার বা গোবর ২৫০ গ্রাম টিএসপি, ১০০ গ্রাম ইউরিয়া ও ১০০ গ্রাম এমওপি সার প্রতি বছর দিতে হবে। উক্ত সার সমান দুইভাগে ভাগ করে এক ভাগ বর্ষার আগে এবং অন্যভাগ বর্ষার পরে প্রয়োগ করতে হবে। গর্তে চারার গোড়া থেকে কিছুটা দূরে চর্তুদিকে কোদাল দিয়ে কুপিয়ে উক্ত সার মাটির সাথে মিশিয়ে সেচ দিতে হবে। গাছের বয়স ৫ বছরের বেশি হলে একই পরিমাণ সার দিতে হবে ৪ বার। কিভাবে সার দিতে হবে তা নি¤েœর সারণির মাধ্যমে দেখানো হলো।
দারুচিনির বাকল সংগ্রহ, শুকানো, সংরক্ষণ ও ফলনঃ
ফসল সংগ্রহঃ দারুচিনির বাকলই এর ফলন। দারুচিনি গাছের বাকল সাধারণত ৩ বছর বয়সের পর থেকে সংগ্রহ করতে হয়। এ সময় গাছ ২ মিটার লম্বা ও গাছের গোড়া ৮-১২ সে.মি. মোটা হয়। এ পর্যায়ে গাছ কাটা ও বাকল সংগ্রহের উপযুক্ত সময়। বছরে ২ বার বাকল উঠানো যায়। প্রথমবার মে মাসে, দ্বিতীয়বার নভেম্বরে। ২ মিটার লম্বাডাল কাটা ভালো। সকালে ডাল কেটে স্তুপ করে পাতা ঝরাতে হয়। গোড়া থেকে সব ডাল কেটে ফেলার পর পুণরায় ডালপালা গজায় এবং পরের বছর আহরণের উপযুক্ত হয়। কর্তিত ডালগুলোর বাকল হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ঢিলা করে নিতে হয়। এতে করে বাকলের ভিতরের স্তর কাগজের মতো মুড়ে বা রোল করে উঠে আসবে। বাইরের খসখসে স্তর ফেলে দিতে হবে। মিটার খানেক লম্বা বাকল রোদে দিলে শুকিয়ে চোঙ্গাকৃতি বা কুইল (ছঁরষষ) হয়।
বাকল শুকানোঃ কর্তিত বাকল বাঁশের চাটাই বা প্লাষ্টিকের উপর রেখে রোদে দিতে হবে। উল্লেখিত চোঙ্গাকৃতি (Quill) শুকনো বড় বড় বাকলগুলোকে ৫-১০ সে.মি. টুকরা করে বিক্রির জন্য প্রক্রিয়াজাত করতে হবে। সাধারণত বস্তায় ভর্তি করে প্রায় ১৩২ কেজি বা ৬০ পাউন্ডের এক একটি গাইট রূপে দারুচিনি রপ্তানি করতে হয়।
ফলনঃ হেক্টর প্রতি ৪৫০-৫০০ কেজি শুকনো দারুচিনি ফসল পাওয়া যায়।
সংরক্ষণঃ দারুচিনি সংরক্ষণের জন্য ভালো মানের দারুচিনির কাঠি আলাদা করতে হবে। এ ভাবে বাচাই করে গ্রেডিং করতে হবে। উঁচু মানের দারুচিনির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- পাতলা, মসৃণ ও হালকা বাদামি রঙের হবে। নি¤œমানের দারুচিনির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে গাঢ় বাদামি রঙের, পুরু ও খসখসে হয়। দারুচিনির গুঁড়ো সংরক্ষণ করা যায় না। কারণ তাতে ভেজাল দেয়া হয়। ঠান্ডা বা খরের শীতলতম এবং শুস্ক স্থানে বা বড় কাঁচের বৈয়ামে বা পাত্রে মুখ ভাল করে এটে সংরক্ষণ করতে হবে। এভাবে দারুচিনি কয়েকমাস পর্যন্ত ভালো রাখা যায়। ফ্রিজেও দারুচিনি সংরক্ষণ করা যায়। খোলা অবস্থায় রাখলে দারুচিনির সুঘ্রাণ থাকবে না। বাতাসের সংস্পর্শে বাকলের ‘সিনামালডিহাইড’ রাসায়নিক পদার্থ ক্রমে উড়ে চলে যায়, যা দারুচিনির ঘ্রাণের জন্য দায়ী।
Reviews
There are no reviews yet.